ভাল বাজারমূল্য পেতে চিংড়ি বাজারজাত করার পূর্বে এর গুণগতমান বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আহরণ ও আহরণ পরবর্তী ব্যবস্থাপনার ওপর চিংড়ির গুণগতমান ও বাজার মূল্য নির্ভর করে। আহরণ হতে প্রক্রিয়াজাতকরণ কার্যক্রম শুরুর পূর্ব পর্যন্ত সঠিক পরিচর্যা করা অত্যন্ত জরুরী ও প্রয়োজনীয়। চিংড়ি আহরণের ক্ষেত্রেও সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে সফলভাবে চিংড়ি চাষ করে চিংড়ির সন্তোষজনক ফলন পাওয়া যায় না। চিংড়িকে অক্ষত রেখে অল্প সময়ের মধ্যে চিংড়ি আহরণ করা উচিত। স্বল্প সময়ে আহরণ করলে চিংড়ির গুণগতমান ভালো থাকে এবং ক্রেতার নিকট থেকে ভালো দাম পাওয়া যায়।
এই অধ্যায় পাঠ শেষে আমরা-
চিংড়ি চাষ ব্যবস্থাপনার শেষ ও গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হচ্ছে আহরণ ও বাজারজাতকরণ। সঠিক সময়ে চিংড়ি আহরণ ও বাজারজাত করতে না পারলে চিংড়ি চাষে আশানুরুপ লাভ পাওয়া যায় না। খোলস বদলানোর মধ্যবর্তী সময়ে চিংড়ি আহরণ করা উত্তম। তাছাড়া ভোর বেলা চিংড়ি আহরণ করা উচিত যাতে সময়মত চিংড়ি বাজারজাত করা সম্ভব হয়। সময়মত চিংড়ি বাজারজাত করা সম্ভব না হলে গুণগতমান বিনষ্ট হয় এবং বাজারে চাহিদা থাকে না।
খাবার বা বিক্রির উদ্দেশ্যে পুকুর হতে চিংড়ি ধরাই হচ্ছে আহরণ। লাভজনকভাবে চিংড়ি চাষের জন্য সঠিক সময় ও সঠিক পদ্ধতিতে আহরণ অপরিহার্য। চিংড়ি কখন আহরণ করতে হবে তা সাধারণত চিংড়ির গড় ওজন ও বাজার দরের ওপর নির্ভরশীল। তবে খামার বা পুকুরের পরিবেশগত অবস্থা ঠিক থাকলে গলদা চিংড়ি ৬-৮ মাসের মধ্যেই বাজারজাতকরণের উপযাগেী হয়ে উঠে। চাষ পদ্ধতিতে সাধারণত অমাবস্যা বা পূর্ণিমার “জো” বা “গোন”-এর সময় চিংড়ির আহরণ করা হয়। পুকুরের ৫% এর বেশি চিংড়ির খোলস নরম থাকলে চিংড়ি আহরণ করা ঠিক নয়। সাধারণত অমাবস্যা ও পূর্ণিমার ভরা কাটালের ২-৩ দিন পর অধিকাংশ চিংড়ির খোলস শক্ত থাকে এবং মরা কাটালের পর সাধারণত অধিকাংশ চিংড়ির খোলস নরম থাকে। তাই ভরা কাটালের সর্বোচ্চ জোয়ারের ২-৩ দিন পরই চিংড়ি আহরণের উত্তম সময় এবং পরিষ্কার আবহাওয়ায় মাছ ও চিংড়ি ধরা উচিত। বিশেষ করে ভোর বেলা মাছ ও চিংড়ি ধরার উত্তম সময়। এ ছাড়াও স্থানীয় বাজারের সময়ও বিবেচনায় রাখতে হবে।
মাথাসহ ৭০-৮০ গ্রাম ওজনের চিংড়ি আহরণ করা লাভজনক। সাধারণত এ ওজনে পৌঁছানোর পরপরই চিংড়ি আহরণ শুরু করা হয়। চিংড়ি আহরণের জন্য সাধারণত ঝাঁকি বা খেপলা জাল, বেড় জাল অথবা বাঁশের তৈরি বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ ব্যবহার করা হয়। তবে চিংড়ি চাষ পদ্ধতির ওপর নির্ভর করেই আহরণ পদ্ধতি নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। গলদা চিংড়ি সাধারণত দুই পদ্ধতিতে আহরণ করা হয়; যথা-
বিভিন্ন প্রকার চাষ পদ্ধতির আলোকে নির্বাচন পদ্ধতিতে চিংড়ি আহরণ করা হয়। বিভিন্ন প্রকার চাষ পদ্ধতিতে যেমন পার্থক্য আছে ঠিক তেমনি আহরণ পদ্ধতিতেও বিভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। বিভিন্ন প্রকার চাষ পদ্ধতির ক্ষেত্রে চিংড়ি আহরণের উপায়গুলো নিচে বর্ণনা করা হলো-
ক) মিশ্র চাষ পদ্ধতির আহরণ এই পদ্ধতিতে চাষের ক্ষেত্রে মাছের ওজন ৫০০ গ্রাম হলে এবং চিংড়ির ওজন ৭০ থেকে ৮০ গ্রাম (মাথা সহ) হলে এদের ধরে ফেলা উচিত। সাধারণত পোনা মজুদের ৩ মাস পর থেকে জাল টেনে উপরোক্ত ওজনের মাছ ও চিংড়ি আহরণ করে বাজারজাত করা দরকার। বিশেষ করে বড় চিংড়ি আহরণ করা উচিত। কেননা চিংড়ি স্বজাতিভোজি প্রাণী। ফলে বড় ও সবল চিংড়ি সদ্য খোলস পাল্টানো ছোট দুর্বল চিংড়িকে খেয়ে ফেলার সম্ভাবনা বেশি থাকে। মিশ্র চাষের পুকুরে চিংড়ি আহরণের জন্য সাধারণত খেপলা জাল, বেড় জাল ও বাঁশের চাই ব্যবহার করা হয়। তবে বাঁশের চাই ব্যবহার করে চিংড়ি আহরণ করা ভাল। এতে ছোট চিংড়ির আঘাত পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা থাকে না।
খ) দলগত চাষ বা ব্যাচ কালচার পদ্ধতির আহরণ: এ পদ্ধতিতে একই সময়ে একই বয়সের চিংড়ির পোনা পুকুরে মজুদ করা হয়। ৩-৪ মাস পর চিংড়ি বাজারজাতকরণের উপযোগী হলে প্রতি মাসে জাল টেনে বড় চিংড়িগুলিকে আগেই ধরে ফেলা হয় এবং ৭-৮ মাস পর পুকুরের সম্পূর্ণ পানি বের করে দিয়ে বাকি চিংড়ি আহরণ করা হয়।
প) অনবরত চাষ পদ্ধতির আহরণ: এ পদ্ধতিতে পোনা মজুদের ৩-৪ মাস পর প্রতি “জো” তে জাল দিয়ে বড় আকারের চিংড়ি আহরণ করা হয় এবং আহরণকৃত চিংড়ির সমপরিমাণ পোনা পুনরায় উক্ত পুকুরে মজুদ করা হয়। পরবর্তীতে অধিকাংশ চিংড়ি বিক্রয়যাগ্যে আকারে পরিণত হলে পুকুরের সম্পূর্ণ পানি বের করে বাকি চিংড়ি ধরে ফেলা হয়। সম্প্রসারিত বা উন্নত হালকা সম্প্রসারিত চাষ পদ্ধতিতে এভাবে চিংড়ি আহরণ করা হয়ে থাকে। সাধারণত পোনা মজুদের ৬-৭ মাস পর থেকেই এই পদ্ধতিতে চিংড়ি আহরণ শুরু করা হয়।
সনাতন, উন্নত হালকা চাষ পদ্ধতি বা আধা-নিবিড় চাষ ইত্যাদি সকল প্রকার চাষ পদ্ধতির ক্ষেত্রেই সম্পূর্ণ ফলন আহরণ পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। তবে চিংড়ির মিশ্রচাষের ক্ষেত্রে এ পদ্ধতিতে আহরণ সুবিধাজনক। চিংড়ি আহরণের আগে চাষির নিম্নবর্ণিত প্রস্তুতি ও আহরণকালীন সাবধানতা গ্রহণ করা উচিত : -
পুকুর বা জলাশয়ের আয়তন এবং চিংড়ি আহরণের পরিমাণের ওপর ভিত্তি করেই আহরণের জাল বা ফাঁদ নির্বাচন করা হয়। গলদা চিংড়ি আহরণে সাধারণত নিম্নবর্ণিত সরঞ্জাম ব্যবহার করা হয়।
যদি পুকুর আয়তনে বড় হয় এবং বেশি পরিমাণে মাছ ও চিংড়ি ধরতে হয় সেক্ষেত্রে বেড় জাল ব্যবহার করা হয়ে থাকে। বেড় জালের ফাঁসের আকার ১/২ ইঞ্চি হওয়া উচিত। জাল উচ্চতার পানির গভীরতার দ্বিগুণ এবং লম্বায় পুকুরের দৈর্ঘ্যের কমপক্ষে দেড়গুণ হওয়া উচিত। একই পুকুরে একই দিনে দুবারের বেশি জাল টানা উচিত নয়। এতে মাছ ও চিংড়ির উপর চাপ পড়ে এবং ছোট মাছ ও চিংড়ি আঘাত প্রাপ্ত হয়ে মারা যেতে পারে। জাল টানার পর যথাশীঘ্র বড় মাছ ও চিংড়ি ধরে ছোটগুলোকে ছেড়ে দেয়া উচিত।
চিত্র-৪.১: বেড় জাল দিয়ে চিংড়ি আহরণ
যদি স্বল্প পরিমাণ মাছ ও চিংড়ি ধরতে হয় সেক্ষেত্রে ঝাঁকি জানই উত্তম। মাছ ও চিংড়ি ধরার ২০-২৫ মিনিট আগে পুকুরে খাদ্য প্ররোগের নির্দিষ্ট স্থানে ৩-৫টি খাদ্য বল নিলে এদের ধরা সহজ হয়।
চিত্র-৪.২: কি জাল দিয়ে গলদা আহরণ
খুনি, সুন্নাত, ধোছনা ইত্যাদি পেতে রেখে চিংড়ি আহরণ ইদানিং বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
চিত্র-৪.৩: গলদা আহরণে ব্যবহৃত ট্র্যাপ
চিংড়ির আহরণের জন্য এ পদ্ধতি সবচেয়ে কার্যকর। এ ক্ষেত্রে পুকুরের সমস্ত পানি নিষ্কাশন করে চিংড়ি আহরণ করা হয়।
বাংলাদেশে উৎপাদিত চিংড়ির আহরণ পরবর্তী ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত দুর্বল। সে কারণে রপ্তানি বাণিজ্যে প্রায়শই প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে সুনাম এবং উৎপাদিত পণ্যের আশানুরূপ নাম পেতে হলে পুকুর থেকে চিংড়ি আহরণের পর বেশিক্ষণ ফেলে রাখা যাবে না। এতে দ্রুত চিংড়ির পচন ধরে এবং চিংড়ির গুণগতমান নষ্ট হয়ে যায়। জীবিত অবস্থায় চিংড়ির খোলস, ফুলকা, পাকস্থলী ও নেহের অন্যান্য অংশে অসংখ্য ব্যাকটেরিয়া থাকে। কিন্তু চিংড়ি জীবিত থাকা অবস্থায় এর কোন ক্ষতি করতে পারে না। তবে মারা যাওয়ার পর সাধারণ তাপমাত্রায় ব্যাক্টেরিয়া চিংড়িকে অতি দ্রুত আক্রমণ করে ফলে পচনক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। এছাড়া সাধারণ তাপমাত্রার চিংড়ির দেহস্থ প্রোটিওলাইটিক এনজাইমের ক্রিয়ার ফলে চিংড়ির পচন অধিক দ্রুত হয়। চিংড়ি আহরণোত্তর পরিচর্যাকালীন বিবেচ্য বিষয়সমূহ নিম্নে দেয়া হলো-
পরিষ্কার পানিতে চিংড়ি ধোয়ার পর গ্রেড অনুযায়ী চিংড়ি বাছাই ও ওজন করা হয়। চিংড়ি বাছাই-এর ক্ষেত্রে চিংড়ির গুণগতমান যথার্থ রয়েছে কী না তা পরীক্ষা করে নেয়া হয়। চিংড়ির গুণগতমান যথার্থ থাকা সত্ত্বেও যদি চিংড়ির খোলস ভেঙে যায় বা খোলসের রঙের পরিবর্তন হয়, তাহলে বাছাই করার সময় এ ধরনের চিংড়ি বাদ দেয়া হয়। নিম্নের ছকে গলদা চিংড়ির গ্রেডিং দেয়া হলো-
সারণিঃ গলদা চিংড়ির গ্রেডিং
গ্রেড | মাথাসহ প্রতি কেজিতে সংখ্যা | গ্রেড | মাথা ছাড়া প্রতি ৫০০ গ্রামে সংখ্যা |
---|---|---|---|
৫ | ৫ পর্যন্ত | ৫ পর্যন্ত | |
১০ | ৬-১০ | ৬-৮ | |
২০ | ১১-২০ | ৯-১২ | |
৩০ | ২১-৩০ | ২১-৩০ | |
৫০ | ৩১-৫০ |
প্রাচীনকাল থেকেই মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য বিভিন্ন ধরনের প্যাকিং সামগ্রী ব্যবহার করে পরিবহণ করা হয়। যেমন- কাঠের বাক্স, চামড়া ও কাপড়ের ব্যাগ, মাটির পাত্র ও বান্ডিল তৈরির জন্য রশি ইত্যাদি । যথাযথভাবে পণ্য সংরক্ষণ, সুষ্ঠ পরিবহণ ও হস্তান্তর প্রক্রিয়াকে সহজতর করা ও সর্বোপরি পণ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করাই হলো প্যাকিং এর মূল উদ্দেশ্য। মৎস্য পণ্য পরিবহণ করার জন্য বর্তমানে ধাতুর তৈরি পাত্রের সাথে সাথে গ্লাস, কাগজ ও প্লাস্টিক দ্বারা তৈরি পাত্র ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সাধারণত তাজা চিংড়ি প্লাস্টিক বাক্স বা খাদযুক্ত বাক্সে প্যাকিং করে পরিবহণ করা হয়। প্লাস্টিক বাক্স হালকা, শক্ত ও স্বাস্থ্যসম্মত বিধায় বর্তমানে প্লাস্টিক বাক্সের ব্যবহার অত্যধিক।
অধিক পরিমাণে তাজা মাছ ও ফ্রোজেন চিংড়ি প্যাকিং এর ক্ষেত্রে সাধারণত রেসিন করা কাগজের মন্ডের বাক্স ব্যবহার করা হয়। তবে ফাইবার বোর্ড বাক্স ও করোগেটেড বোর্ড কার্টুন বেশি ব্যবহৃত হয়, কারণ এগুলোর উপর পলিথিনে আবৃত থাকে। এছাড়া ব্লক ফ্রোজেন প্যাকিং এর ক্ষেত্রে খোলস ছাড়ানো চিংড়ি ফাইবার বোর্ড কার্টুন দিয়ে প্যাকেট করা হয়। সমস্ত প্যাকেটটি ফ্রোজেন করা হয় ফলে প্যাকেট পণ্যকে রক্ষা করে এবং শক্ত বৈশিষ্ট্যের কারণে ব্লক ফ্রোজেন প্যাক খুব সহজেই সংরক্ষণ ও পরিবহণ করা যায়। এ পদ্ধতির অসুবিধা হলো প্যাকেটের একটা চিংড়ি বের করতে হলে সমস্ত বরফ গলাতে হয়। তবে আইকিউএফ (Individual Quick Freezing) পদ্ধতিতে চিংড়ি সংরক্ষণ খুচরা বিক্রেতা এবং সরবরাহকারীদের নিকট খুবই জনপ্রিয় কারণ এর ফলে প্রয়োজন অনুযায়ী চিংড়ি বিক্রি ও সরবরাহ করা যায়। আইকিউএফ পদ্ধতিতে খোলস ছাড়ানো চিংড়ি ও মাছ প্যাকেট করা হয়। চিংড়ি পরিবহনকালীন বিবেচ্য বিষয়সমূহ হলো-
আকার ও গুণগতমান অনুযায়ী বাছাইকৃত চিংড়ি বাজারজাতকরণের জন্য সুবিধাজনক পরিবহন পাত্রে বরফ ও চিংড়ি স্তরে স্তরে সাজাতে হবে। আহরণ ও বাজারজাতকরণের মধ্যবর্তী সময়ে চিংড়িকে ছায়াযুক্ত স্থানে রাখার ব্যবস্থা করা উচিত। পরিবহন বাক্সে বা পাত্রের তলায় এক স্তর বরফ দিয়ে তার ওপর একন্তর চিংড়ি সাজাতে হবে। এভাবে পর্যাযক্রমে বরফ ও চিংড়ি সাজানোর পরে সবার ওপরে পুরু করে একস্তর বরফ দিয়ে প্যাকিং করতে হবে। এভাবে চিংড়ি সাজানোর সময় খেয়াল রাখা উচিত যেন পাত্রে ২ ফুটের বেশি উচ্চতায় চিংড়ি সাজানো না হয়। কারণ এতে উপরের চিংড়ি ও বরফের চাপে নিচের চিংড়ি দৈহিক বা আকৃতিগত ক্ষতির আশংকা থাকে।
বাংলাদেশে সাধারণত বাজারজাতকরণের জন্য ডিপোতে বা অবতরণ কেন্দ্রে চিংড়ি বাজারজাতকরণ করে প্যাকিং করা হয়। পরিবহন দূরত্বের ওপর নির্ভর করেই সাধারণত বরফ ব্যবহারের মাত্রা নির্ধারণ করা হয়। পরিবহন সময়ের ওপর নির্ভর করে নিম্নহারে বরফ ব্যবহার করা হয়।
পরিবহন সময় | বরফ ও চিংড়ির অনুপাত |
---|---|
১২-১৮ ঘণ্টা | ১-১ |
১৮-২৫ ঘণ্টা | ১.৫-১ |
২৪-৪৮ ঘন্টা | ২.১ |
চিংড়ি পরিবহনের সময়ের সাথে সাথে তার গুণগতমান অনেকাংশেই বরফ টুকরার আকারের ওপর নির্ভরশীল। পরিবহন সময় অনুযায়ী বরফ টুকরার আকার নিচে দেয়া হলোঃ
পরিবহন সময় | বরফ টুকরায় আকার |
১২ ঘণ্টা | বরফ গুঁড়া/বরফকুচি |
১২-২৪ ঘণ্টা | ছোট/মাঝারি বরফ টুকরা |
বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত চিংড়ির কোনো সুষ্ঠু বিপণন ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি। ফলে চিংড়ি চাষি ও ক্রেতাদের মধ্যে বহু মধ্যবর্তী লোক বিপণনের সাথে জড়িত। এসব মধ্যস্বত্বভোগীদের চিংড়ির মতো একটি মূল্যবান সম্পদ সঠিক ভাবে ক্রয়-বিক্রয় করার ব্যাপারে কোন সঠিক জ্ঞান বা প্রশিক্ষণ না থাকায় অনেক সময় উৎপাদিত পণ্য বিপণনের পূর্বেই নষ্ট হয়ে যায়। ফলে চিংড়ি চাষিরা ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হয়। চিংড়ি সরাসরি পুকুর থেকে ফড়িয়া বা মধ্যবর্তী লোকদের মাধ্যমে প্রক্রিয়াজাত কারখানায় চলে যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অত্যন্ত অস্বাস্থকর পরিবেশে চিংড়ির মাথা ও খোসা ছাড়ানোসহ অন্যান্য পরিচর্যা করা হয়। এসময় চিংড়ি বিভিন্ন ক্ষতিকর ব্যাক্টেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত হয়। এভাবে যথাযথ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় এবং নিম্ন বর্ণিত কারণে প্রক্রিয়াজাত কারখানায় পৌঁছানোর পূর্বেই চিংড়ির গুনগত মান নষ্ট হয়ে যায়-
মূলত অণুজীবের কর্মতৎপরতা ও দেহাভ্যন্তরস্থ জৈব পদার্থে বিদ্যমান এনজাইমের বিক্রিয়ার ফলে চিংড়ির মৃত্যুর পর পচনক্রিয়া শুরু হয়। আর এ জন্য আহরণের পরপরই পচন রোধের ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। তাই চিংড়ি আহরণের পর যথাযথ পরিচ্ছন্নতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ, ব্যাকটেরিয়ার স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও কার্যকলাপ রহিতকরণ এবং ব্যাকটেরিয়া ধ্বংসকরণের মাধ্যমে গুণগতমান অক্ষুন্ন রাখা এবং সংরক্ষণকাল বৃদ্ধি করা সম্ভব। এছাড়া চিংড়ি পণ্যকে বাতাসের আর্দ্রতা, পোকা-মাকড়, ধুলা বালি ইত্যাদি থেকে রক্ষার জন্য অবশ্যই ভালভাবে প্যাকেজিং করা উচিত। ভাল প্যাকেজিং করে না রাখলে চিংড়ি পণ্যের গুণগতমান অতি দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়।
মাছ বা চিংড়ির মৃত্যুর পর যে প্রক্রিয়ায় এর ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য যেমন- স্বাভাবিক গঠন, স্বাদ, গন্ধ, বর্ণ ইত্যাদির ব্যাপক অবনতি ঘটে তাকে পচনক্রিয়া বলে। পচন দুইভাবে হতে পারে যথা:
(১) রাসায়নিক পচন বা ব্যাকটেরিয়া ছাড়া পচন, এবং
(২) ব্যাকটেরিয়াজনিত পচন।
(১) রাসায়নিক পচন বা ব্যাকটেরিয়া ছাড়া পচন: এটি দুইভাবে হয়ে থাকে, যথা-দৈহিক এনজাইমঘটিত পচন ও র্যানসিডিটি। জীবিত অবস্থায় যেসব এনজাইম বিপাকীয় কাজে সহায়তা করে সেগুলো মাছের মৃত্যুর পর প্রোটিন, চর্বি ও কার্বোহাইড্রেট এর ব্যাপক ভাঙন ঘটায়, ফলে দেহে সাধারণ পচন শুরু হয়। এই পচনকে স্বয়ংক্রিয় পচনও বলে। দৈহিক এনজাইমের স্বয়ংক্রিয় কার্যকলাপের মাধ্যমে পেশীকে দুর্বল করে ফেলে এবং ব্যাকটেরিয়ার প্রবেশ ও বৃদ্ধিতে সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করে।
চর্বিযুক্ত মাছের ক্ষেত্রে এই ধরনের র্যানসিডিটি পচন ঘটে। মাছের চর্বি অসম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড দ্বারা গঠিত হওয়ায় বাতাসের অক্সিজেনের উপস্থিতিতে এগুলো জারিত হয় ফলে মাছ হালকা খয়েরী বর্ণ ধারণ করে। র্যানসিডিটির ফলে অনেক সময় মাছের পেট ফেটে যায় এবং জলীয় পদার্থ নিঃসৃত হতে থাকে।
(২) ব্যাকটেরিয়াজনিত পচন: সদ্য আহরিত চিংড়ির পেশিতে এবং দেহ রসে সাধারণত কোনো ব্যাকটেরিয়া থাকে না। তবে মাছ বা চিংড়ির ফুলকা, অন্তর ও ত্বকীয় শ্লেষ্মায় প্রচুর ব্যাকটেরিয়া থাকে। ব্যাকটেরিয়া মাছ পচনে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এরা মাছ বা চিংড়িকে খাদ্যের সম্পূর্ণ অনুপযোগী করে তোলে। জলীয় পরিবেশে ব্যাকটেরিয়া সহজে বিস্তার লাভ করে। আহরণের সময়ই প্রচুর ব্যাকটেরিয়া মাছের দেহের বিভিন্ন অংশে আশ্রয় লাভ করে। চিংড়ির পচনে সহায়ক কয়েকটি ব্যাকটেরিয়ার হলো- অ্যারোমাব্যাক্টার, সিউডোমোনাস, ফ্লাভোব্যাকটেরিয়াম, মাইক্রোকক্কাস, অ্যারোমোনাস, ক্লস্ট্রিডিয়াম ইত্যাদি।
চিংড়ি মানুষের কাছে একটি আকর্ষণীয় খাদ্য। কিন্তু আহরণের পর খুব সহজেই এর খাদ্যমান নষ্ট হয়ে যায়। আর এ জন্য আহরণের পরপরই পচন রোধের ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। সাধারণভাবে চিংড়ির পচন দুইটি কারণে ত্বরান্বিত হয়, যথা- সময় ও তাপমাত্রা। চিংড়ি আহরণের পর থেকে বাজারজাত বা প্রক্রিয়াজাতকরণের মধ্যবর্তী সময় যত বেশি হবে চিংড়ির পচন তত বেশি হবে। সে কারণে চিংড়ি আহরণের পরে পরিবহন ও বাজারজাতকরণে যত কম সময় ব্যয় হয় ততই চিংড়ি বেশি টাটকা বা তাজা থাকবে। সুতরাং চিংড়ি সংরক্ষণের মূলনীতি হলো এমন সব পদক্ষেপ গ্রহণ করা যার দ্বারা পচন সহায়ক কারণসমূহকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। চিংড়ির পচন রোধে নিম্নবর্ণিত পদক্ষেপসমূহ গ্রহণ করা হয়।
ক) পরিচ্ছন্নতা: পরিচ্ছন্নতা রক্ষা করার উদ্দেশ্য হলো আহরিত চিংড়ি যেন পচনশীল অন্য কোনো বস্তুর সংস্পর্শে এসে দুষিত না হয় এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ যেন চিংড়িকে কলুষিত করতে না পারে। আহরিত চিংড়ি অবতরণ কেন্দ্রে আনার সময় এদের খাদ্যনালী, দেহ গহবরে ও ফুলকায় প্রচুর ব্যাকটেরিয়া থাকে। এছাড়া শরীরের বাহিরাংশে শ্লেষ্মায়ও প্রচুর ব্যাকটেরিয়া থাকে। নড়াচড়া বা পরিচর্যাকালে ধুলাবালি, কাদা- ময়লা ও অপরিষ্কার পানি বা বরফ ইত্যাদির দ্বারা চিংড়ি কলুষিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে, অর্থাৎ ত্রুটিপূর্ণ পরিচর্যা চিংড়ির পচনকে ত্বরান্বিত করে। সুতরাং চিংড়িকে উত্তমরূপে ধৌতকরণে এবং ফুলকা ও অগ্ন অপসারণের মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ অনেকটা হ্রাস করা সম্ভব। সুতরাং পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার মাধ্যমে মাছ বা চিংড়ির পচনকে অনেকটা কমানো যায়।
খ) ব্যাকটেরিয়ার স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও কার্যকলাপ রহিতকরণ: এই পদ্ধতিতে বিভিন্ন কৌশলে চিংড়ির দেহের বিদ্যমান ব্যাকটেরিয়ার স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও কার্যকলাপকে থামিয়ে দিয়ে চিংড়িকে সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেয়া হয়। এই পদ্ধতিতে কৌশলসমূহ নিম্নরূপ-
পচন রোধে নিম্ন তাপের ব্যবহারঃ বরফ দিয়ে বা যান্ত্রিক পদ্ধতিতে চিংড়ির দেহের তাপমাত্রা হ্রাসের মাধ্যমে এনজাইম ও ব্যাকটেরিয়ার কার্যকারিতা ব্যাহত করা হয়। যেমন- শীতলীকরণ ও হিমায়িতকরণ।
আর্দ্রতা অপসারণের মাধ্যমে পচন রোধঃ এটি এমন একটি পদ্ধতি যেখানে মাছের দেহের পানি অপসারণ বা কমিয়ে ফেলা হয়। এটা প্রাকৃতিকভাবে যেমন- সূর্যালাকে বা কৃত্রিম উপায়ে বা রাসায়নিক পদ্ধতিতে করা হয়। চিংড়ির শরীরের আর্দ্রতা এমন এক মাত্রায় কমানো হয় যেখানে ব্যাকটেরিয়া ও এনজাইমের কার্যকারিতা নিষ্ক্রিয় হয়। যেমন- লবণায়ন, শুষ্ককরণ বা শুটকিকরণ, ধূমায়িতকরণ ও নিরুদিকরণ প্রভৃতি পদ্ধতির মাধ্যমে চিংড়ির পচন রোধ করা যায়।
সংরক্ষক দ্রব্য প্রয়োগের মাধ্যমে পচন রোধঃ বিভিন্ন সংরক্ষক দ্রব্য প্রয়োগের মাধ্যমে চিংড়িকে পচনের হাত থেকে রক্ষা করা যায় বা সংরক্ষিত চিংড়ির সংরক্ষণ সময় দীর্ঘায়িত করা যায়। চিংড়ির সংরক্ষক হিসেবে ভিনেগার ও লবণ ব্যবহার করা হয়। তাজা বা হিমায়িত চিংড়ি সাধারণ তাপমাত্রায় এনে জীবাণুমুক্ত অবস্থায় সংরক্ষণ করা হয়। এ চিংড়িকে ৫-১০% অ্যাসিটিক অ্যাসিড ও ১০-১৫% লবণের দ্রবণে এক সপ্তাহ বা বেশি সময় ডুবিয়ে রাখা হয়। এ অবস্থায় চিংড়ির আমিষ জমাট বেঁধে যায়। এসব চিংড়ি তখন ১-২% অ্যাসিটিক অ্যাসিড ও ২-৪% লবণ দ্রবণে চূড়ান্তভাবে বোতলজাত করা হয়। এভাবে বোতলজাত চিংড়িকে ০ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রায় কমপক্ষে ৩ মাস ভালো অবস্থায় সংরক্ষণ করা যায়।
গ) ব্যাকটেরিয়া ধ্বংসকরণের মাধ্যমে সংরক্ষণ: এই পদ্ধতিতে আহরিত মাছ বা চিংড়িকে পরবর্তীকালে ব্যবহারের জন্য দীর্ঘ সময় ধরে গুণগতমান সম্পন্ন রাখার জন্য উচ্চ তাপমাত্রায় বায়ুরোধক পাত্রে সংরক্ষণ করা হয়। এই পদ্ধতিকে টিনজাতকরণ পদ্ধতি বলা হয়। এই প্রক্রিয়ায় ব্যাকটেরিয়া, ইস্ট, মোল্ড সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয় এবং বায়ুরোধক পাত্রে রাখার কারণে নতুন করে কোনো প্রকার ব্যাকটেরিয়া প্রবেশের সুযোগ পায় না। এই প্রক্রিয়ায় সংরক্ষিত মাছ বা চিংড়ির স্বাভাবিক মৌলিক স্বাদের কিছুটা পরিবর্তন হলেও গুণাগুণের কোনো পরিবর্তন ঘটে না।
তাপমাত্রার ওপর ভিত্তি করে নিম্ন তাপমাত্রায় মাছ সংরক্ষণ পদ্ধতিকে দুইভাগে ভাগ করা যায়।
স্বল্প সময়ের জন্য চিংড়ির সজীবতা রক্ষার্থে শীতলীকরণ অত্যন্ত সুবিধাজনক পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে চিংড়ির তাপমাত্রা হিমাঙ্কের কাছাকাছি আনা হয়, তবে হিমাঙ্কের নিচে নয়। এ পদ্ধতি খুব দ্রুত ও দক্ষতার সাথে পরিচালনার মাধ্যমে খুব ভালো ফল পাওয়া যায়। তবে দীর্ঘ সময়ের জন্য সংরক্ষণে শীতলীকরণ পদ্ধতি অনুপযোগী। আহরণের পরপরই যদি চিংড়িকে অন্তর্বর্তীকালীন সংরক্ষণের প্রয়োজন হয়, যেমন এক স্থান থেকে অন্য স্থানে প্রেরণ, অবতরণ কেন্দ্র থেকে বাজারে বা প্রক্রিয়াজাত কারখানায় প্রেরণের প্রয়োজন হয় তবে এ পদ্ধতি অবলম্বনে ভালো ফল পাওয়া যায়। শীতলীকরণের প্রধান লক্ষ্য হলো মাছের তাপমাত্রাকে ০ ডিগ্রি সে. এর কাছাকাছি নিয়ে আসা। শীতলীকরণের উপায়সমূহ হলো-
ক) বরফ ব্যবহার করেঃ নিম্ন তাপমাত্রায় মাছ সংরক্ষণের একটি স্বল্পকালীন পদ্ধতি। স্বাদু পানি থেকে উৎপাদিত টুকরো বা গুঁড়ো বরফ ব্যবহার করে চিংড়িকে আচ্ছাদিত করা হয়। ফলে মাছের পচন সাময়িকভাবে রাখে করা যায়। কারণ সঠিকভাবে চিংড়ির তাপমাত্রা (০° সে. ৪ ডিগ্রি সে.) কমিয়ে আনার ফলে এনজাইম, জারণ ও ব্যাকটেরিয়াজনিত পরিবর্তন কমিয়ে দেয় এবং বরফগলা পানি চিংড়ির উপর দিয়ে প্রবাহিত করে এবং ব্যাকটেরিয়া, রক্ত, শ্লেষ্মা ইত্যাদি ধৌত করে।
খ) সংরক্ষক ও বরফ ব্যবহার করেঃ অনেক সময় সংরক্ষিত মাছের গুণাগুণ ভালো রাখার জন্য ও বরফের গুণাগুণ উন্নয়নের জন্য বরফের সাথে কিছু ব্যাকটেরিয়ানাশক বা অন্য যে কোনো ধরনের সংরক্ষক ব্যবহার করা হয়। এ কাজে ব্যবহৃত দ্রব্যগুলারে নাম হলো- সোডিয়াম বেনজোয়েট, ফিউমারিক অ্যাসিড, কার্বন ডাই অক্সাইড, ডাই সোডিয়াম ফসফেট, বেনজোয়িক অ্যাসিড, সোডিয়াম নাইট্রাইট, হাইড্রোজেন পার অক্সাইড ইত্যাদি।
গ) শীতল সামুদ্রিক পানি ব্যবহার করেঃ বরফ ব্যবহারের বিকল্প পদ্ধতি হিসেবে ঠান্ডা সামুদ্রিক পানিতে চিংড়িকে ডুবিয়ে রেখে শীতলীকরণ করা যায়। সামুদ্রিক ট্রলারে এই পদ্ধতি কার্যকরভাবে ব্যবহার করা হয়। ট্রেলারের মধ্যে কোনো সুবিধাজনক পাত্র বা ট্যাংকে সমুদ্রের পানি যান্ত্রিকভাবে কমপ্রেসর এবং কুলিং পাইপের সাহায্যে বা বরফ মিশ্রিত করে ২ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রায় নিয়ে আসা হয়। বৃহৎ ফ্রিজিং ট্রলারে আহরিত মাছকে হিমায়িতকরণের পূর্বে এভাবে শীতলীকরণ করা হয়।
হিমায়িতকরণ পদ্ধতি শীতলীকরণ পদ্ধতি হতে অধিক কার্যকর। চিংড়িকে দীর্ঘ সময়ের জন্য সংরক্ষণের লক্ষ্যে এ পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়। হিমায়িতকরণ পদ্ধতিতে মাছ বা মৎস্যজাত দ্রব্যের দেহের তাপমাত্রা হিমায়ন যন্ত্র ব্যবহার করে -৮ ডিগ্রি সে. বা তারও কম রাখা হয়। সাধারণত চিংড়িকে -৩০ ডিগ্রি সে. থেকে ৪০ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রায় হিমায়িত করা হয়।
মাছের শরীরে প্রচুর পানি থাকে যা ০ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রায় বরফে পরিণত হয় না। কারণ এ পানির সাথে লবণ ও অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থ থাকে। মাইনাস ১ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রায় মাছের দেহের পানি জমতে শুরু করে এবং মাইনাস ৫ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রায় প্রায় ৮০% পানি বরফে পরিণত হয়। এ অবস্থায় অহিমায়িত পানিতে লবণের ঘনত্ব ক্রমে বাড়তে থাকে। ফলে মাছ পূর্ণ হিমায়িত হতে আরও বেশি তাপমাত্রা কমানোর প্রয়োজন হয়ে পড়ে। মাইনাস ৩০ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রায় ও মাছের ভিতরের ১০% পানি অহিমায়িত থাকে, বিধায় মাইনাস ৩৫-৪০° সে. পর্যন্ত তাপমাত্রা ব্যবহার করা হয়। চিংড়ি হিমায়িতকরণে তিনটি স্তরে তাপমাত্রা নিচের দিকে নামে।
প্রথম স্তরে তাপভাত্রা খুব দ্রুত এবং ভালভাবে ০ ডিগ্রি সে. বা এর সামান্য নিচ পর্যন্ত নামে। দ্বিতীয় স্তরে তাপমাত্রা ০° থেকে -১৭°সে পর্যন্ত নামে ঐখানে প্রায় স্থির থাকে। তৃতীয় পর্যায়ে এসে তাপমাত্রা আরও নিচে নামে এবং অবশিষ্ট অহিমায়িত অংশ হিমায়িত হয়। এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো হিমায়িতকরণের দ্বিতীয় স্তরে, সবচেয়ে সময় বেশি লাগে এবং ঐ সময়ে তাপমাত্রা সহজে নিচে নামে না বা খুব সামান্য নিচে নামে। এই স্তর বা সময়টাকে হিমায়িতকরণের সংকটকাল বলা হয়। কারণ ভালোভাবে চিংড়িকে হিমায়িত করতে হলে এ সময়টা অতি দ্রুত অতিক্রম করতে হবে। তা না হলে হিমায়িত চিংড়ির গুণাগুণে ত্রুটি দেখা দিতে পারে। তৃতীয় স্তরে এসে তাপমাত্রা আরও নিচে নামে এবং অবশিষ্ট অহিমায়িত অংশ হিমায়িত হয়।
মাছ বা চিংড়ির হিমায়িতকরণের জন্য বিভিন্ন ধরনের হিমায়ক যন্ত্র বা ফ্রিজার ব্যবহার করা হয়ে থাকে। নিয়ে কয়েকটি হিমায়ক যন্ত্রের বর্ণনা দেয়া হলো-
ক) এয়ার ব্লাস্ট ফ্রিজারঃ এ ধরণের ফ্রিজারের ভিতর দিয়ে ঠান্ডা বাতাসের বাষ্প প্রবাহিত করে মাছ বা অন্যান্য খাদ্য দ্রব্যকে হিমায়িত করা হয়। এয়ার ব্লাস্ট ফ্রিজার দুই প্রকারের হয়ে থাকে। যথা-
(১) অনবরত ফ্রিজারঃ এ প্রকার ফ্রিজারে হিমায়িতকরণের সময় দ্রব্য বা Product ঘুরতে থাকে। হিমায়কের ভিতর এক পাশ থেকে মাছ বা দ্রব্যাদি ঢুকানো হয় এবং অন্য পাশ দিয়ে হিমায়িত উপাদান বের করা হয়।
(২) ব্যাচ ফ্রিজারঃ ব্যাচ ফ্রিজারে মাছ বা চিংড়ি বা দ্রব্য প্রবেশ করানো হয় এবং একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত রেখে হিমায়িত করা হয়।
বিভিন্ন প্রকার ফ্রিজারের মধ্যে এয়ার ব্লাস্ট ফ্রিজার সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয়। কারণ এর ব্যবহারে সুবিধাগুলো হচ্ছে- এ জাতীয় ফ্রিজার বহুমুখী কাজে ব্যবহার করা হয়, এ জাতীয় ফ্রিজারে হিমায়িতকরণে কম খরচ করা হয় এবং হিমায়তকরণের সময় কম পরিচর্যা করলেই চলে।
খ) কন্ট্যাক্ট প্লেট ফ্রিজারঃ এ ধরনের হিমায়ক যন্ত্রে চিংড়িকে সরাসরি হিমায়িত প্লেটের ওপর রেখে হিমায়িত করা হয়। কন্ট্যাক্ট প্লেট ফ্রিজার চার প্রকারের হয়ে থাকে। যেমন- প্লেট ফ্রিজার, ব্যান্ড ফ্রিজার, রোটারি ফ্রিজার এবং ড্রাম ফ্রিজার। এগুলোর মধ্যে প্লেট ফ্রিজার সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয়। এ ধরনের ফ্রিজারে চিংড়িকে ফাঁপা ধাতুর প্লেটের মধ্যে রাখা হয় যার মধ্যে শীতলীকরণের জন্য রেফ্রিজারেন্ট প্রবাহিত করা হয়।
বাণিজ্যিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে কন্ট্যাক্ট প্লেট ফ্রিজার তাপ নিরোধক পৃথক রুমে ( Insulated room) স্থাপিত থাকে যেখানে মাছকে প্যাকেট বা ব্লক সংযুক্ত আকারে হিমায়িত করা হয়। প্রতিটি মাছ বা চিংড়ির ব্লক ৫০-৬০ মিলিমিটার পুরু হয়। ব্লক তৈরির জন্য প্লেটগুলোতে সংযুক্ত পাম্পের সাহায্যে ঠান্ডা লবণ পানি (Cold brine), অ্যামোনিয়া বা রেফ্রিজারেন্ট ১২ বা ২২ প্রবাহিত করা হয়। ফলে মেটাল প্লেটের তাপমাত্রা ৩৫-৪০ ডিগ্রি সে. হয়ে থাকে। মৎস্যজাত দ্রব্য দ্রুত হিমায়িতকরণের জন্য কন্ট্যাক্ট প্লেট ফ্রিজার ব্যবহার করা হয়। সাধারণত চিংড়ি ও অন্যান্য ছোট ছোট মাছ ব্লক আকারে এই প্রকার ফ্রিজে হিমায়িত করা হয়।
গ) ইমারসন ফ্রিজার: এ ক্ষেত্রে মাছকে নিম্ন তাপমাত্রায় তরল পদার্থে ডুবানো বা নিমজ্জিত করা হয়। এভাবে সরাসরি ঠান্ডা তরলের মধ্যে রেখে মাছের দেহের তাপমাত্রা কমানোর পদ্ধতি এয়ার ব্লাস্ট ফ্রিজারে ঠান্ডা বাতাস প্রয়োগ থেকে উৎকৃষ্ট। পানির ফ্রিজিং পয়েন্টের চেয়ে এ পদ্ধতিতে ব্যবহৃত তরল পদার্থের ফ্রিজিং পয়েন্ট অনেক বেশি হয়ে থাকে। বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য ইমারসন ফ্রিজারের কোনো আদর্শ নকশা নেই এবং বিভিন্ন প্রকার ব্যবহারের জন্য বিভিন্নভাবে পরিবর্তন করা হয়ে থাকে। সাধারণত ঠান্ডা লবণ পানি অথবা কোন রেফ্রিজারেন্ট বাম্পকে পাম্প এর সাহায্যে ক্রমাগত মৎস্যজাত দ্রব্যের ওপর প্রবাহিত করা হয় অথবা মৎস্যজাত দ্রব্যকে একমুখী ঠান্ডা দ্রবণের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত করানো হয়। মাছ ধরার ট্রলারে চিংড়ি হিমায়িতকরণে ইদানিংকালে লবণ পানির দ্রবণের সাথে ২০% গ্লুকোজ এবং ২০% খাবার লবণ যোগ করে সাফল্যজনকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ইমারসন ফ্রিজারে মাছ ধরার ট্রলারে প্যাকেটকৃত নয় (Unpacked) এমন মাছের হিমায়িতকরণের জন্য উপযুক্ত।
ঘ) শার্প ফ্রিজার: শার্প ফ্রিজার একটি পৃথক ইনসুলেটেড বা তাপ নিরোধক ঘর যার তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রি সে. রাখা হয়। এ ফ্রিজারে বিভিন্ন আকারের কয়েল দ্বারা তৈরি সেলফ থাকে যার ভিতর দিয়ে ঠান্ডা লবণ পানি, অ্যামোনিয়া বা অন্যান্য রেফ্রিজারেন্ট প্রবাহিত করা হয়। হিমায়িতকরণের সময় মাছ বা চিংড়িকে সরাসরি সেলফে বা অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি প্যানের ওপর রাখা হয়। এ পদ্ধতিতে তাপমাত্রার পরিবর্তন খুব ধীর গতিতে হয়। কারণ মৎস্যদ্রব্যের সম্পূর্ণ উপরিভাগ (surface) ফ্রিজারের পাইপের সংস্পর্শে থাকতে পারে না। এবং ফ্রিজারের ভিতর বায়ু চলাচল সীমিত। এ প্রকার হিমায়ন পদ্ধতি ধীরগতি সম্পন্ন ও পুরাতন বিধায় এর ব্যবহার বর্তমানে অত্যন্ত সীমিত।
মাছ বা অন্য কোন খাদ্যদ্রব্যের আসল গুণাগুণ ধরে রাখা এবং কোনরূপ কলুষিতকরণ ও সংক্রমণ হতে রক্ষা করার জন্য কোন দ্রব্যাদি দ্বারা মাছ বা খাদ্য দ্রব্যকে মোড়ানোর পদ্ধতিকে প্যকেটজাতকরণ বলা হয়। আধুনিক বিপণন ব্যবস্থায় বিভিন্ন উপায়ে পরিচর্যা ও প্রক্রিয়াজাত করার পর মাছ ও মৎস্য জাত দ্রব্যকে সংরক্ষণ, নিরাপদ ও সহজ পরিবহন এবং পরবর্তীতে কোনরূপে কলুষিত বা সংক্রমিত হওয়া থেকে রক্ষা করার জন্য প্যাকেটজাতকরণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্যাকেটজাতকরণের উদ্দেশ্যগুলো নিম্নরূপ-
(১) ধারক হিসেবে কাজ করে,
(২) বিভিন্নভাবে নষ্ট হওয়া থেকে রক্ষা করে,
(৩) উপযোগ সৃষ্টি করে, এবং
(৪) ভোক্তার সাথে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে।
চিংড়ি পণ্য বাজারজাতকরণের বিভিন্ন পর্যায়েও গুণগতমান হারাতে পারে। চিংড়ি পণ্য বাজারজাত করার জন্য স্থানান্তরের সময় বা বাজারজাতকরণের পরে বিক্রেতার দোকানে অসাবধানতার কারণে চিংড়ি পণ্যের প্যাকেট ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে ও চিংড়ি পণ্যের গুণগতমান নষ্ট হতে পারে। দোকানে দীর্ঘ দিন অবিক্রিত রয়ে গেল চিংড়ি পণ্যের গুণাগুণ নষ্ট হতে পারে। কাজেই বাজারজাতকরণের সময়ে ও তৎপরবর্তী বিক্রয়ের সময়ে বিশেষভাবে চিংড়ি পণ্যের মাননিয়ন্ত্রণ করা অপরিহার্য।
স্বাস্থ্যসম্মত ও উন্নত চিংড়ি পণ্যের খবর ক্রেতার নিকট পৌঁছানো অতি জরুরি। চিংড়ি পণ্যের ভোক্তারা সাধারণভাবে চিংড়ি পণ্যের স্বাদের বিচার বিশ্লেষণ করে থাকে। চিংড়ি পণ্যের সকল ক্ষেত্রে হ্যাসাপ মেনে স্বাস্থ্যসম্মতভাবে তৈরি কিনা সে ব্যাপারে সচেতনতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ পদ্ধতি প্রয়োগ করলে মৎস্যজাত খাদ্যে যে জীবাণুগত সমস্যা এবং নষ্ট হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে তা মাননিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে গুণগত মানসম্পন্ন খাদ্যসামগ্রী বিশ্বে বাজারজাত করা সহজ হবে। এই হ্যাসাপ পদ্ধতি বাস্তবায়নের ফলে প্রায় ১০০ ভাগ খাদ্যসামগ্রীকে অণুজীবঘটিত রোগের সংক্রমণ থেকে রোধ করা সম্ভব। বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যে বিশ্বের মোট খাদ্য উৎপাদনের শতকরা ৫ ভাগ খাদ্য ভোক্তাদের কাছে পৌঁছার আগেই নষ্ট হয়ে যায়। এই প্রেক্ষিতে সুদীর্ঘ গবেষণার পর বিজ্ঞানীরা একমত পোষণ করেন যে, খাদ্য উৎপাদনের উৎসস্থল থেকে যে সকল কারণে খাদ্য সংক্রমিত হচ্ছে তা নিরীক্ষা এবং নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ভোক্তাদের নিরাপদ স্বাস্থ্য এবং সুন্দর জীবন উপহার দেয়া সম্ভব।
'হ্যাজার্ড এনালাইসিস ক্রিটিক্যাল কন্ট্রোল পয়েন্ট' এর সংক্ষিপ্ত রূপ হচ্ছে হ্যাসাপ (HACCP)। কোনো খাদ্যের গুণগতমান নিশ্চিত করার লক্ষ্য এটি হচ্ছে একটি আধুনিক পদ্ধতি। কোনো খাদ্যপণ্যের কাঁচামালের উৎসস্থল থেকে শুরু করে উৎপাদনের প্রতিটি ধাপে সম্ভাব্য ক্ষতিকর পদার্থ, জীবগত ও রাসায়নিক বিষয়গুলোকে (হ্যাজার্ড) এ পদ্ধতির সাহায্যে চিহ্নিত করা হয়। প্রতিটি ধাপে চিহ্নিত হ্যাজার্ডগুলোকে প্রতিরোধের জন্য সুনির্দিষ্ট নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নেয়া হয়। এরপর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাগুলোর হ্যাজার্ড প্রতিরোধের সক্ষমতা এবং সংশ্লিষ্ট হ্যাজার্ডগুলোর দ্বারা বিপদ সৃষ্টির সম্ভাবনাসমূহ চিহ্নিত করা হয়। এই চিহ্নিত বিপদ সৃষ্টির সম্ভাবনাগুলোর নিরিখে উৎপাদন প্রক্রিয়ার কোন কোন ধাপ সংকটপূর্ণ তা চিহ্নিত করে কেবলমাত্র ঐ সমস্ত ধাপেই বিশেষ নিয়ন্ত্রণ কৌশল বাস্তবায়ন করা হয়।
চিংড়িতে ক্ষতিকর জীবাণু, কীটনাশক, অ্যান্টিবায়োটিক, হরমোন বা অন্যান্য ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য পাওয়া গেলে আমদানিকারক দেশগুলো এরকম চিংড়ি গ্রহণ করে না। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত চিংড়ির যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে এদেশ থেকে রপ্তানিকৃত চিংড়িতে বিভিন্ন ক্ষতিকর জীবাণু, নোংরা ও ময়লা বস্তু এবং বিভিন্ন অপদ্রব্যের উপস্থিতির কারণে বাংলাদেশের চিংড়িকে সাধারণত নিম্নমানের চিংড়ি হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে।
বাংলাদেশে চিংড়ির চাষ পর্যায়ে রাসায়নিক ও জীবগত হ্যাজার্ড সংক্রমণের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। চিংড়ি চাষ এবং পরিবেশের ওপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ নেই বললেই চলে। বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনা করে বর্তমানে বিশেষজ্ঞগণ চাষ পর্যায়ে হ্যাসাপ বাস্তবায়নের ওপর বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করেছেন।
বাংলাদেশ থেকে রপ্তানিকৃত মৎস্য পণ্যে এমন সব ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ এবং অণুজীবের উপস্থিতির কথা বলা হচ্ছে যেগুলোর প্রয়োগ ও সংক্রমণ চাষ পর্যায়েই ঘটার সম্ভাবনা বেশি। তাই চিংড়িতে নাইট্রোফুরান ও ক্লোরামফেনিকল নামক ক্ষতিকর অ্যান্টিবায়োটিক এবং টাইফয়েড ও কলেরার ন্যায় মারাত্মক রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুর উপস্থিতির বিষয়টি উল্লেখ করা যেতে পারে। চিংড়িতে উক্ত ক্ষতিকর অ্যান্টিবায়োটিক ও জীবাণুর উপস্থিতির কারণে প্রতিবছর রপ্তানিকৃত বেশ কিছু পরিমাণ চিংড়ি বিদেশ থেকে ফেরৎ আসে। ফলে একদিকে রপ্তানিকারকগণ যেমন আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রন্ত হচ্ছেন তেমনি বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। তাই এ আশঙ্কাজনক অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য মাছ ও চিংড়ির চাষ পর্যায়ে হ্যাসাপ নীতিমালা বাস্তবায়নের উদ্যোগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তোমার প্রতিষ্ঠানের কাছাকাছি যেকোন একটি চিংড়ি ঘের/পুকুর পরিদর্শন কর যেখানে নিয়মিত জাল টেনে চিংড়ি আহরণ করা হয়। আহরিত চিংড়ি কিভাবে সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণ করা হচ্ছে তা পরিদর্শন কর এবং এর কর্ম পরিবেশ ও উৎপাদন সংক্রান্ত বিষয়ে নিম্নোক্ত ছকে তোমার মতামত দাও।
পরিদর্শনকৃত মৎস্য খামারের নাম | |
ঠিকানা | |
কি কি উপায়ে চিংড়ি আহরণ করা হয়? | |
চিংড়ি আহরণের ক্ষেত্রে কি কি আহরণ সরঞ্জামাদি বা গিয়ার ব্যবহার করা হয়? | |
চিংড়ি আহরণের পূর্বে আহরণ পূর্ববর্তী কি কি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়? | |
কর্মী সংখ্যা কত? | |
কর্মীগণ কাজের সময় কি কি ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম ব্যবহার করে? | |
চিংড়ি খামারের পরিবেশ সম্পর্কে তোমার মতামত দাও | |
তোমার নাম শ্রেণি রোল নং প্রতিষ্ঠানের নাম শ্রেণি শিক্ষকের নাম | |
প্রতিবেদন জমাদানের তারিখ | শিক্ষকের স্বাক্ষর |
তোমার প্রতিষ্ঠানের কাছাকাছি যেকোন একটি চিংড়ি কারখানা পরিদর্শন কর যেখানে মাছ সংরক্ষণের বিভিন্ন পদ্ধতি যেমন-চিংড়ি বাছাইকরণ, বরফ পানি দ্বারা চিংড়ি ধৌতকরণ, খোসা অবমুক্তকরন ইত্যাদি কাজ গুলো পর্যবেক্ষন এবং পরিদর্শন শেষে এর কর্ম পরিবেশ ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ে নিম্নের ছকে তোমার মতামত দাও।
পরিদর্শনকৃত চিংড়ি কারখানার নাম | |
ঠিকানা | |
কিভাবে চিংড়ি বাছাইয়ে করা হয়? | |
চিংড়ি বাছাই কি কি উপকরণ ব্যবহার করা হয়? | |
বরফ পানি দ্বারা চিংড়ি কিভাবে ধৌত করা হয়? | |
চিংড়ি কিভাবে গ্রেডিং করা হয়? | |
চিংড়ির খোসা অবমুক্ত করতে কি কি উপকরণ ব্যবহার করা হয়? | |
কর্মী সংখ্যা কত? | |
কর্মীগণ কাজের সময় কি কি ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম ব্যবহার করে ? | |
চিংড়ি কারখানার পরিবেশ সম্পর্কে মতামত দাও | |
তোমার নাম শ্রেণি রোল নং প্রতিষ্ঠানের নাম শ্রেণি শিক্ষকের নাম প্রতিবেদন জমাদানের তারিখ | শিক্ষকের স্বাক্ষর |
পারদর্শিতার মানদণ্ড
(ক) ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম
(খ) প্রয়োজনীয় উপকরণ
(গ) কাজের ধারা
১। নিকটস্থ কোন গলদা চিংড়ির পুকুরের পাড়ে যাও।
২। বেড় জাল দিয়ে সমস্ত ঘের বা পুকুরের চিংড়ি টেনে এক জায়গায় নিয়ে আসো।
৩। এবার প্রয়োজনীয় সংখ্যক জনবল নিয়ে বেড় জাল দিয়ে যতটা সম্ভব চিংড়ি ধরে ফেলো।
৪। এবার পাম্প মেশিন দিয়ে পুকুরের পানি সম্পূর্ণ রুপে নিষ্কাশন করে ফেলো।
৫। অতঃপর হাত দিয়ে ছোট বড় সব চিংড়ি ধরে ফেলো।
৬। আহরিত চিংড়ি ঝুড়িতে রাখো।
৭। আহরণকৃত মাছের ওজন, দাম, জেলের পারিশ্রমিক ইত্যাদি রেকর্ড বইতে লিখে রাখো।
৮। গৃহীত কার্যক্রমের ধারাবাহিক প্রতিবেদন ব্যবহারিক খাতায় লেখ।
সতর্কতা
আত্মপ্রতিফলন
ঘের বা পুকুরের চিংড়ি ধরার দক্ষতা অর্জিত হয়েছে/হয় নাই/আবার অনুশীলন করতে হবে।
পারদর্শিতার মানদণ্ড
(ক) ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম
(খ) প্রয়োজনীয় উপকরণ
(গ) কাজের ধারা
১। চিংড়ি ধরার পর পরই ছায়াযুক্ত স্থানে চাটাই বা পলিথিন পেপারের উপর রাখো।
২। এবার চিংড়ি গুলো পরিষ্কার পানি দিয়ে ধৌত করো।
৩। পরিষ্কার পানি দিয়ে ধৌত চিংড়ি গুলোকে এবার ড্রামের ভেতর বরফ মিশ্রিত পানিতে রাখো।
৪। এবার চিংড়ি গুলোকে বরফ থেকে তুলে ট্রেতে রাখো।
৫। অতঃপর চিংড়িগুলো বিভিন্ন গ্রেডে বাছাই করো।
৬। গ্রেড অনুযায়ী চিংড়িগুলো বিভিন্ন ট্রেতে সঠিক নিয়মে বরফ ও চিংড়ি স্তরে স্তরের সাজাও।
৭। ট্রেতে স্তরে স্তরে সাজানো চিংড়িগুলোকে ভেজা চট দিয়ে ঢেকে ছায়াযুক্ত স্থানে রাখো।
৮। প্রাথমিক ধৌতকরণ ও গ্রেডিং এর পদ্ধতিটি ধারাবাহিকভাবে ব্যবহারিক খাতায় লেখ।
সতর্কতা
তাপমাত্রা বেশি থাকলে আহরণের প্রথম ৩ ঘন্টার মধ্যেই চিংড়ির গুণগত অবস্থার বেশি অবনতি ঘটে। এ অবস্থা রোধ কল্পে অল্প পরিমাণ চিংড়ি আহরণ পূর্বক ঠান্ডা পানি দিয়ে ধৌত করে ছায়াযুক্ত স্থানে রাখতে হবে।
উপযুক্ত মূল্য পাওয়ার জন্য চিংড়ির গ্রেডিং যথাযথ ভাবে হওয়া একান্ত দরকার। এজন্য আহরিত চিংড়ি খামার থেকেই সঠিক ভাবে গ্রেডিং করে বাজারজাত করণের জন্য প্যাকিং করতে হবে।
আত্মপ্রতিফলন
আহরিত চিংড়ি বাছাই করার দক্ষতা অর্জিত হয়েছে/হয় নাই/আবার অনুশীলন করতে হবে।
পারদর্শিতার মানদন্ড
(ক) ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম
(খ) প্রয়োজনীয় উপকরণ
(গ) কাজের ধারা
১. প্রথমে নির্দিষ্ট পরিমাণ (কুঁড়ির আকার অনুযায়ী) টাটকা বা তাজা গলদা চিংড়ি সংগ্রহ করো।
২. গলদা চিংড়ির ওজনের উপর ভিত্তি করে নির্দিষ্ট পরিমাণ গুঁড়া অথবা ব্লক বরফ সংগ্রহ করে ঝুড়িতে বরফ এবং গলদা চিংড়ি স্তরে স্তরে সাজাও।
৩. ব্লক বরফ এর ক্ষেত্রে ব্যবহারের পূর্বে হাতুড়ি কিংবা কাঠের টুকরার সাহায্যে চটের ব্যাগের মধ্যে রেখে গুঁড়া করো।
৪. ঝুড়িটি পরিষ্কার পানিতে ধোয়ার পর প্রথমে ঝুড়ির ভিতরের চারিদিকে চটের একটি আস্তরণ দাও। অতপর ঝুড়ির তলায় ২ ইঞ্চি পুরু বরফের একটি স্তর দাও।
৫. তারপর এক স্তর গলদা চিংড়ি এবং এক স্তর বরফ এভাবে সাজিয়ে ঝুড়ি ভর্তি করো।
৬. ঝুড়ি পূর্ণ হবার পর এক স্তর বরফ দিয়ে তার উপর চটের টুকরা দিয়ে চেপে সেলাই করে ঝুড়ির মুখ বন্ধ করো।
৭. অনুশীলনকৃত কার্যক্রমটি খাতায় লিপিবদ্ধ করতে হবে।
সতর্কতা
আত্মপ্রতিফলন
সনাতন পদ্ধতিতে বরফ দ্বারা গলদা চিংড়ি সংরক্ষণ কৌশল প্রয়োগ করার বিষয়ে দক্ষতা অর্জিত হয়েছে/হয় নাই/আবার অনুশীলন করতে হবে।
পারদর্শিতার মানদন্ড
(ক) ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম
খ) প্রয়োজনীয় উপকরণ
(গ) কাজের ধারা
১. এই ক্ষেত্রে প্রথমে প্রমাণ সাইজের (২০-৩০ কেজি) বাঁশের ঝুড়ির ভিতরের দিকটা প্লাস্টিকের বস্তা দিয়ে সেলাই করে মুড়ে দাও। চটের কিছু অংশ বাড়তি থাকবে।
২. চট দিয়ে মোড়ানোর পর ঝুড়ির ভিতরে এমনভাবে হোপলার পাটি বিছিয়ে দাও যাতে হোগলার কিছু অংশ বাড়তি থাকে।
৩. হোগলার উপর আর এক প্রস্থ প্লাস্টিকের বস্তা পূর্বের ন্যায় সেলাই করে দাও।
৪. এবার সেলাই করা প্লাস্টিকের উপর পাতলা পলিথিন শিট বিছিয়ে দাও ।
৫. প্রথমে পলিথিন শিটের উপর এক স্তর বরফ রেখে গলদা চিংড়ি সাজিয়ে দাও। এর পর ভাঁজে ভাঁজে বরফ ও গলদা চিংড়ি স্তর সাজিয়ে উপরে অতিরিক্ত বরফ দিয়ে বাড়তি চট, হোগলা ও পলিথিন শিট এক সাথে মুড়ে ঝুড়ির মুখ বাঁধো
৬. এই ধরণের ঝুঁড়ির ক্ষেত্রে ঝুড়ির তলায় বরফ গলা পানি বের হয়ে যাওয়ার জন্য ছিদ্র থাকে। কিন্তু সনাতন পদ্ধতিতে বাঁশের ঝুড়িতে গলদা চিংড়ি পরিবহনের সময় ছিদ্র না থাকার কারণে বরফ গলা পানি সমস্যা সৃষ্টি করে।
৭. এই পদ্ধতিতে ঝুঁড়ির তলার পলিথিন, হোগলা ও প্লাস্টিকের চট ছিদ্র করে ১ সে.মি. ব্যাসের ২ ফুট লম্বা একটি প্লাস্টিকের নল ঢুকিয়ে শক্ত করে বেঁধে দাও। এবার নলের অপর প্রান্ত বাঁকিয়ে ঝুড়ির উপরের দিকে এক প্রান্তে বেধে রাখো।
৮. এইভাবে বরফ দেয়া গলদা চিংড়ি ২৪ ঘণ্টা পুনরায় বরফ না দিয়েও গুণাগুণ যথাযথ রেখে সংরক্ষণ করা যায়। প্রতি ২৪ ঘন্টা অন্তর অন্তর একবার করে গলদা চিংড়ি উপর সামান্য বরফ দাও।
সতর্কতা
আত্মপ্রতিফলন
আধুনিক পদ্ধতিতে বরফ দ্বারা গলদা চিংড়ি সংরক্ষণ কৌশল প্রয়োগ করার বিষয়ে দক্ষতা অর্জিত হয়েছে/হয় নাই/আবার অনুশীলন করতে হবে।
অতি সংক্ষিপ্ত উত্তর প্রশ্ন
১. প্রচলিত পদ্ধতিতে চাষকৃত চিংড়ি সাধারণত কোন সময়ে আহরণ করা হয়?
২. কত ওজনের চিংড়ি বাজারজাতকরনের জন্য লাভজনক?
৩. গলদা চিংড়ি কয়টি পদ্ধতিতে আহরণ করা হয়?
৪. অনবরত চাষ পদ্ধতিতে পোনা মজুদের কয় মাস পর থেকে সাধারণত চিংড়ি আহরণ করা শুরু হয়?
৫. আহরণকৃত চিংড়ি বরফ মিশ্রিত পানিতে কত সময় ডুবিয়ে রাখতে হয়?
৬. চিংড়ির নতুন খোলস শক্ত হতে সাধারণত কত দিন প্রয়োজন হয়?
৭. পরিবহন সময় ১২-১৮ ঘন্টা হলে বরফ ও চিংড়ি ব্যবহারের অনুপাত কত হবে?
৮. পচন ক্রিয়ার চিংড়ির কোন গুনাবলি নষ্ট হয়?
৯. চিংড়ির পচন রোধে গৃহীত পদক্ষেপগুলোর নাম কী?
১০. কী কী উপায়ে চিংড়ি শীতলীকরণ করা যায়?
১১. নিম্ন তাপমাত্রায় চিংড়ি সংরক্ষনের পদ্ধতিগুলোর নাম কী?
১২. চিংড়ি কত তাপমাত্রায় হিমায়িত করা হয়?
সংক্ষিপ্ত উত্তর প্রশ্ন
১. যে সব কারণে প্রক্রিয়াজাত কারখানায় পৌঁছার পূর্বেই চিংড়ির গুনগতমান নষ্ট হয় তা বর্ণনা করো।
২. চিংড়ি আহরণের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ আহরণ পদ্ধতি বর্ণনা করো।
৩. বাংলাদেশের চিংড়ি বিপণন ব্যবস্থা বর্ণনা করো।
৪. বিভিন্ন ধরনের হিমায়ক যন্ত্রগুলোর নাম লেখ।
৫. র্যানসিডিটি বলতে কী বোঝ?
৬. দ্রুত হিমায়িতকরণ বলতে কী বোঝ?
৭. দ্রুত হিমায়িতকরণের সুবিধাগুলো লেখ।
রচনামূলক প্রশ্ন
১. গলদা চিংড়ির আহরণ পদ্ধতি বর্ণনা করো।
২. গলদা চিংড়ির বাজারজাতকরণ পদ্ধতি বর্ণনা করো।
৩. চিংড়ির গুনগতমান অক্ষুন্ন রাখার কৌশল বর্ণনা করো।
৪. চিংড়ি শীতলীকরণের উপায়সমূহ বর্ণনা করো।
আরও দেখুন...